ব্যাস্তবতার অন্যরূপ
আমার বিয়ে হয়েছে, একটা বিবাহিত ব্যাচেলরের সাথে। অবশ্য বউ মারা গেলে তাকে widower বা বিপত্নীক বলে। কিন্তু বিপত্নীক শব্দটা বলতে আমার ভালো লাগে না। তার চেয়ে বিবাহিত ব্যাচেলর কথাটা বেশ ভালো শোনায়।
হয়ত সবাই ভাবছেন যে এই বিবাহিত ব্যাচলর কে আমি কেনো বিয়ে করলাম! আসলে আমার সমবয়সী বা দু' চার বছরের সিনিয়র কোনো ছেলেই আর অবিবাহিত ছিল না, এটা অবশ্য আমার ধারণা।আমি একজনকে ভালবাসতাম আর তার প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য আমি নয় বছর অপেক্ষাও করে ছিলাম। প্রতিষ্ঠিত হবার পর সে একদিন দেখা করে একটা বিয়ের কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো-" ফ্যামিলীর চাপা চাপিতে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছি বীথি, তোমাকে বিয়ে করাতে কেউ রাজী নয়, ফ্যামিলীকে ম্যানেজ করতে পারলাম না।
আই এম সো স্যরি বিথী!"আমি চুপচাপ শুনছিলাম। কি বলবো আমি? কি বলা উচিত আমার?
সে তো সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে যে সে আমাকে বিয়ে করবে না। তারপরেও ওকে কিছু বলে নিজেকে ছোট করা কি ঠিক হবে আমার?
যদি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদি তবে কি সে ফিরবে আমার জীবণে?
না ফিরবে না, কারণ সে অলরেডী আমার পথ থেকে আলাদা হয়েই গেছে।
সত্যিই কি একটা ছেলে তার ভালবাসার মানুষের জন্য নিজের ফ্যামিলীকে ম্যানেজ করতে পারে না? আমি মনে করি ছেলেরা সব পারে। এমন কি মেয়েদের সব কাজ ছেলেরা মেয়েদের চেয়েও অনেক ভালো পারে।
এ কারণেই নামী দামী রেস্টুরেন্টের রাঁধুনী গুলো ছেলেই হয়ে থাকে। ছেলেরা একটা বউ থাকতেও আরেকটা বিয়ে করতে পারে যেটা একটা মেয়ের পক্ষে ইম্পসিবল, মেয়রা ডিভোর্স না করে রিম্যারেজ করতে পারে না। তাই আমার মনে হয় পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য ফ্যামিলী কোনো বড় বিষয় হতে পারে না।
আসলে বিদেশ থেকে ডীগ্রি নিয়ে এসে শঙ্খনীল আমার লেভেল থেকে অনেক উপরে উঠে গেছিল তাই আমাকে তার পাশে আর মানায় না। কিন্তু আমি তো দেখতে অসুন্দর নই, আমি উচ্চ বংশের মেয়ে, আমি এবং আমার ফ্যামিলী এডুকেটেড তাহলে আমাকে ওর পাশে কেনো মানাবে না?
ওর হাতের ইশারায় আমার নিরবতা ভাঙলো।
সে বললো-"প্লীজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড বীথি! তুমি যেনো আবার কমবয়সী মেয়েদের মত পাগলামী করে বসো না প্লীজ!"ওর কথা শুনে আমার মনে মনে খুব হাসি পেলো, আমি কি পাগলামী করবো? আর কার জন্যই বা করবো?
সে না বললেও আমি জানি যে আমি কমবয়সী মেয়ে নই। ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমার বয়স সত্যিই অনেক বেশী হয়ে গেছে।
ত্রিশ ছাড়িয়ে গেছে আমার বয়স। কত ভালো ভালো ছেলের সাথে আমার বিয়ে এসেছে, কত ভালো ভালো ছেলেরা প্রোপজ করেছে আমাকে অথচ আমি শঙ্খনীলকে ভালবেসে সব রিফিউজ করেছি।
আর আজ সে আমাকে রিজেক্ট করলো।চলে যাওয়া বয়সটার ক্ষতি পূরণটা কে দেবে আমাকে?
নয় বছর ধরে তাকে ভালবেসে প্রতিক্ষা করার প্রতিদান বোধ হয় একটু বড় সড়োই পেলাম। আমি কিছু না বলে ওর হাত থেকে বিয়ের কার্ডটা নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার অপেক্ষিত নয়টা বছরের জন্য। এই আমি একটা সময় চোখ ধাঁধানো সুন্দরী ছিলাম। বয়সের কারণে আমার সৌন্দর্য্য অর্ধেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। চোখের গভীরতায় সেই উনিশ বছরের তারুণ্যতা আর নেই। ত্বকের সজীবতাও আর আগের মত নেই। কার জন্য সবটা হারিয়েছি?
যে কখনোই আমাকে ভালবাসতেই পারেনী! নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে এই ভেবে যে আমি একটা ভুল যায়গায় মন হারিয়ে ছিলাম ছিঃ!
ছোট বেলা থেকেই আমি সোজাসুজি কথা বলতে পছন্দ করি তাই
রাতে খাবার টেবিলে সবার উদ্দেশ্যে বললাম-
--"বাবা আমার এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করা উচিত, এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে আমার, আর এক সপ্তাহের বেশী সময় আমি নষ্ট করতে পারবো না।"সবাই বিস্ময়ের চোখে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
সবাই চুপচাপ ওরা হয়ত বুঝতে পারছে না যে এখন কি বলা উচিত। বাবা বললেন--
-"অনেক দিন হলো তোমার বিয়ে তেমন ভালো ঘর থেকে আসে না। যখন আসত, যখন আসার সময় ছিল তখন তো তোমার সময় ছিল না।
বিয়ে সাধারণ কিছু নয় যে তোমাকে যার তার সাথেই বিয়ে দিয়ে দিতে পারবো। আমি ঘটক কে ফোন করে দেখবো যে তোমার চেয়ে বয়সে একটু বড় কোনো ছেলে পাওয়া যায় কি না।
"পাঁচ দিন কেটে গেলো তবুও ঐ রকম কোনো পাত্র পাওয়া গেলো না।
এক সপ্তাহ পর একটা পাত্রের সন্ধান মিললো, ছেলেটা বিপত্নী এবং তার একটা আড়াই বছরের মেয়ে আছে। এই প্রোপজটাতে বাসার কেউ রাজী ছিল না। বাচ্চাটা যদি না থাকতো তবে হয়ত বাবা মায়ের আপত্তি থাকতো না।
আমি ছেলেটার ছবি দেখলাম, শ্যামলা গায়ের রঙ, বেশ লম্বা ছয় ফিট+ হবে, মিডিয়াম স্বাস্থ্য, আমার চেয়ে দুই কি তিন বছরের বড় হবে হয়ত।
বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে ছবিটা উঠেছে। বাচ্চাটার চেহারা বেশ মিষ্টি। গায়ের রঙ ফর্সা, বাবার মত দেখতে হয়নী। বাচ্চাটাকে দেখে মনে হলো ঠিক বয়সে আমার বিয়ে হলে এ রকম একটা মেয়ে আমারো হয়ত থাকতো।
আমি বাবা মাকে বলে দিলাম যে এই ছেলেটাকেই আমি বিয়ে করবো।
কারো কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাই না। মনে মনে ভাবলাম ঐ বাচ্চাটার মা আমাকে হতেই হবে।শঙ্খনীলের বিয়ের আগের দিন আমার বিয়ের ডেট ঠিক করালাম। আমি চেয়ে ছিলাম যে শঙ্খনীলের বিয়ের আগেই যেনো আমার বিয়ে হয়।
যে সব কাপুরুষেরা পছন্দের মানুষটিকে বিয়ে না করার কারণ হিসেবে পরিবার আর পরিস্থিতির অযুহাত দেখায় তাদেরকে মনে রাখা মানেই মনটাকে অপমান করা, অসম্মান করা। পৃথিবীতে সবার কাছে আমি তুচ্ছ হতে পারি কিন্তু আমার কাছে আমি তুচ্ছ নই।
বসে বসে শঙ্খনীলের বিয়ে দেখার মত সরল মন আমার আর নেই।
আমার একটা ইনভিটেশন কার্ড ছাপানো জরুরী ছিল কারণ আমি ধার রাখতে পছন্দ করি না। পাত্রপক্ষ চায়নী যে বিয়েটা জাকজমক ভাবে হোক।
তাই ইনভিটেশন কার্ড এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমার একটা মাত্র কার্ড ছাপানো জরুরী ছিল। তাই নিজেই চলে গেলাম কার্ড ছাপাতে। কেউ রাজী হচ্ছিল না মাত্র একটা কার্ড ছাপাতে।
এক'শ টা কার্ডের দাম দিয়ে একটাই কার্ড ছাপানো হলো তবে শর্ত একটাই ছিল যে, সুধী বা জনাব/জনাবা এর স্থানে শঙ্খনীল লেখা থাকবে। আমন্ত্রণে বাবার নামের জায়গায় থাকবে বীথিকা।
এবং খামের উপরের শঙ্খনীলের নামটাও টাইপ করা হবে।
কার্ডটা তৈরী করে শঙ্খনীলের ঠিকানায় কুরিয়ার করে পাঠালাম কারণ কোনো কাপুরুষের সামনে যেতে আমার ইগোতে আঘাত লাগছিল।যথারীতি আমার বিয়েটা সু সম্পন্ন হলো। আমি স্বামীর বাড়িতে গেলাম। একটা রুমে আমাকে বসানো হলো, ফুল দিয়ে তেমন করে সাজানো নয় ঘরটা।
তবে ফুলদানীতে এক গোছা রজনী গন্ধা চোখে পড়লো। আমি রজনী গন্ধা একদম পছন্দ করি না কারণ এর গন্ধটা আমার খুব একটা ভাল লাগে না। অবশ্য আমি যে ফুলটা পছন্দ করি সেটা ফুলদানীতে শোভা পায় না।
ঘন্টাখানেক পর দুই তিনটা মেয়ে আমার বর কে এক রকম জোর করেই এ ঘরে ঢুকিয়ে দিল। ওর নাম তৌসিফুর রহমান। দ্বিতীয় বিয়েতেও কি মানুষ এতটা লজ্জা পায়? কি জানি বাবা আমার অভিজ্ঞতা নেই। সে ঘরে ঢুকে ঠাই দাড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর সে বললো-
--"তোমাকে আমার কিছু বলার আছে"আমি বুঝলাম সে বাংলা সিনেমার মত কিছু কমন ডায়লোগ ঝাড়বে এখন। কি আর করা, শুনি তাহলে।
বললাম-
--"বলুন আমি শুনছি"
সে-"ফ্যামিলীর চাপা চাপিতে বিয়েটা করতে বাধ্য হলাম,তাই তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারলেও অধিকারটা দিতে পারবো না স্যরি
"ওর কথা শুনে আমার কি বলা উচিত? একজন ফ্যামিলীর চাপাচাপিতে আমাকে বিয়ে করতেই পারলো না আর আরেক জন ফ্যামিলীর চাপাচাপিতে বিয়ে করে অধিকার দিতে পারছে না।
তৌসিফের এমন ধরনের কথা শুনে হয়ত সবাই ভাববে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে বা পায়ের তলের মেঝে সরে গেছে এরকম কিছু।
আমি চুপচাপ দাড়িয়ে আছি।
সে বললো-
--"ঠিক আছে গুড নাইট, পাশের রুমে আমার মেয়ে ঘুমিয়ে আছে তাই আমি ঐ রুমেই ঘুমাবো"সে চলে যাচ্ছিল তখন আমি বললাম-
--"দাড়ান, আমারও কিছু বলার আছে"সে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাড়ালো।
আমি বললাম-
--"আপনি কি নাবালক?"সে অবাক হয়ে বললো-
--"মানে?"--"দেখুন আমি স্ট্রেইটফরওয়ার্ড কথা বলতে পছন্দ করি তাই বলছি নাবালকদের জোর করে বিয়ে করানো যায় কিন্তু আপনার মত বয়সী মানুষকে ফ্যামিলী জোর করে বিয়ে দেবে তাও আবার দ্বিতীয় বিয়ে, এটা কি ধুপে টেকার মত এক্সকিউজ হলো? তবুও ধরেই নিলাম আপনাকে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছে তাতে আমার দোষ কোথায়?
আপনাদের পারিবারিক কলহে আমি কেনো ভুক্তভুগী হবো?"সে চুপচাপ দাড়িয়ে, নিরবতা হয়ত ওকে ভর করেছে। আমি কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলাম--
-" দেখুন আমি বাংলা সিনেমার নায়িকা নই যে আপনি অধিকার দেবেন না বললেন আর আমি অধিকার নিলাম না। আপনি বিছানায় ঘুমালেন আর আমি ফ্লোরে। জীবণটা কোনো সিনেমা নয় মিস্টার, যে তিন ঘন্টাতেই শেষ হয়ে যাবে"
--"আমি অনিমার যায়গাটা কখনো অন্য কাউকে দিতে পারবো না।"
--"কে চাইছে আপনার অনিমার জায়গা? মানুষের মনটা এতটাই ছোট নয় যে সেখানে একটা মানুষেই পুরো স্থান ভরে যাবে। আমি অন্য কারো স্থান দখল করতে চাই না। আমি অনিমার পাশে নিজের স্থান গড়ে নেবো।"
--"আমার পক্ষে সম্ভব নয় অন্য কাউকে স্ত্রী ভাবা"
--"সেটা আপনার প্রবলেম আমার নয়"এবার সে একদম চুপ হয়ে গেলো। আমি তাকে বললাম-"আই এম স্যরি টু সে, স্ত্রী হিসেবে আমার যা কিছু প্রাপ্য তার থেকে এক ফোটাও ছাড় আমি দিতে পারবো না।
তবে একটা ছাড় আমি আপনাকে দিতে পারি, সেটা হলো- যেহেতু আপনার একটা সন্তান আছে তাই ইনফিউচার আমি দুটো সন্তানের জায়গায় একটা সন্তান নিতে পারি। আপনার এটা দ্বিতীয় বিয়ে হলেও এটা আমার প্রথম বিয়ে তাই আমি দশটা সাধারণ মেয়ের মত একটা সাধারণ জীবণ চাই।
কোনো কিছু স্যাকরিফাইস করে মহিয়সী হতে চাই না। প্লীজ আপনি পাশের রুম থেকে আপনার বাচ্চাকে এই রুমে নিয়ে আসেন এবং ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে যান"সে চুপচাপ আমার কথা মত তার মেয়েকে এই ঘরে নিয়ে আসলো।
Nice srory
উত্তরমুছুন